শিশুদের যক্ষ্মা দেরিতে শনাক্ত হওয়ার কারণ জেনে রাখুন-সুস্থ থাকুন-Tuberculosis in children
শিশুদের যক্ষ্মার লক্ষণগুলো অন্য কিছু অসুখের মত মনে হয় এবং শিশুরা নিজেদের সমস্যার কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না তাই প্রায়শই তাদের ক্ষেত্রে এই রোগটি নির্ণয় করতে দেরি হয় এবং উপেক্ষিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
বিশ্বব্যাপী মোট যক্ষ্মা রোগীর ১২ শতাংশ শিশু। কিন্তু বাংলাদেশে সঠিকভাবে শনাক্ত না হওয়ার কারণে এই হার চার শতাংশের মতো। শিশুদের হার আরো বেশি হবে বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশে যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনামূল্যে দেয়া হয় এবং সঠিকভাবে ওষুধ সেবন করলে এই রোগ ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাল হয়ে যায়। কিন্তু শিশুদের যক্ষ্মা নির্ণয় সঠিকভাবে না হওয়ার কারণে রোগটি উপেক্ষিত রয়ে যায়।
শিশুদের যক্ষ্মার লক্ষণ
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রেসপারেটরি মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক শামীমা আক্তার বলছেন, যক্ষ্মা হলে বড়দের যে উপসর্গগুলো দেখা যায় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তার কিছু পার্থক্য রয়েছে এবং সেগুলো নির্ণয় করা বড়দের চেয়ে কঠিন। তিনি বলছেন, “এমন যদি হয় যে শিশু খাওয়া দাওয়ার পরও তার ওজন কমে যাচ্ছে, অথবা একটি শিশুর যেভাবে ওজন বাড়ার কথা তার বদলে কয়েক মাস ধরে তার ওজন বাড়ছে না, ওজন একই জায়গায় রয়ে গেছে, বাচ্চার খাওয়ার রুচি চলে গেছে এসব ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সন্দেহ করা উচিৎ যে এগুলো শিশুর যক্ষ্মার উপসর্গ কি না-অনেক সময় দেখা যায় অন্য কোন লক্ষণ নেই কিন্তু শিশু দুর্বল হয়ে পড়ছে, খেলছে না, সারাদিন ঝিমাচ্ছে, শুয়ে থাকতে চাইছে, খিটখিট করছে। শরীরে যক্ষ্মা থাকলে এমন হতে পারে। এছাড়া কোন শিশুর দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে হালকা জ্বর থাকছে, খুসখুসে কাশি, কফ, ঠাণ্ডা, সর্দি এগুলিও বড় লক্ষণ। মনে রাখতে হবে এগুলো যদি টানা দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে থাকে। যক্ষ্মার জ্বর সাধারণত একশ ডিগ্রির মত থাকে। খুব উচ্চ তাপমাত্রা থাকে না। এই জ্বর সাধারণত সন্ধ্যার দিকে বা রাতে বেশি হয়ে থাকে। অধ্যাপক আক্তার বলছেন, অভিভাবকরা এর কোনটি যদি খেয়াল করেন তাহলে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাবেন। যদি আশপাশে শিশু বিশেষজ্ঞ না থাকে তাহলে একজন মেডিসিন অথবা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে পারেন।
যক্ষ্মা যেভাবে হয় এবং যেসব অঙ্গ আক্রান্ত করে
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সংস্থা সিডিসি বলছে যক্ষ্মা খুবই সংক্রামক। মাইকোব্যাক্টেরিয়াম নামে একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে যক্ষ্মা হয়ে থাকে। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে, তার হাঁচি, কাশি বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। কথা থেকেও বাতাসে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। একজন মানুষের কফ ছায়াহীন জায়গায় ফেললে বহুদিন জীবাণু বেঁচে থাকে। অপরিচ্ছন্ন, বদ্ধ, আলো বাতাসহীন ঘরে এটি বেশি ছড়ায়। এক ঘরে বেশি মানুষ থাকলে এটি দ্রুত ছড়ায়। বিভিন্ন রকমের যক্ষ্মা রয়েছে। যে যক্ষ্মা ফুসফুসের ক্ষতি করে সেটি পালমোনারি টিউবারকিউলোসিস। টিবি মেনিনজাইটিস-কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। হাড় আক্রান্ত করে এমন যক্ষ্মাকে বলা হয় স্কেলেটন টিবি বা পটস ডিজিজ। এটি শরীরের গিট ও হাঁটু আক্রান্ত করে। এছাড়া এক প্রকার যক্ষ্মা রয়েছে লিম্ফনোড টিবি যা লসিকা গ্রন্থিকে প্রভাবিত করে। খুব বেশি খারাপ পর্যায়ে গেলে যক্ষ্মা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে শিশু মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে। চোখ ও কানসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যক্ষ্মা শরীরের সকল অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে।
শিশুদের যক্ষ্মা দেরিতে শনাক্ত হওয়ার কারণ
স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা আইসিডিডিআর,বি শিশুদের যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা ও চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের কাজ করছে। সংস্থাটির ইমার্জিং ইনফেকশানস প্রোগ্রামের প্রধান সায়েরা বানু বলছেন, বড়দের ক্ষেত্রে সাধারণত ফুসফুসের যক্ষ্মা বেশি হয়ে থাকে। অন্যদিকে ফুসফুসের বাইরে যে যক্ষ্মাগুলো রয়েছে সেগুলো শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ফুসফুসের যক্ষ্মার তুলনায় যেগুলো শনাক্ত করা মুশকিল তাই শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্ত হতে দেরি হয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, “যেমন লিম্ফনোড টিবি হলে ঘাড়ে, গলায়, বগলের নিচে ছোট ছোট গোটামতো হয়। হাড়ের টিবি হলে পিঠে গোটার মতো হল। এই গুটিতে তেমন ব্যথা থাকে না। যার কারণে বাবা মায়েরাও যক্ষ্মা হয়েছে ভেবে ডাক্তারের কাছে যান না। যখন খুব চোখে পড়ে বা অন্য কোন সমস্যা হয় তখন চিকিৎসকের কাছে গেলে ধরা পড়ে। আর ফুসফুসের টিবি ছাড়া অন্য যেসব যক্ষ্মা রয়েছে সেগুলো শনাক্ত করার পদ্ধতি বাংলাদেশে এখনো অনেক কম-তাছাড়া আমরা ধরেই নেই যক্ষ্মা মানেই ফুসফুস, অনেক দিন ধরে কাশি, কাশির সাথে রক্ত। এটা একটি স্টেরিওটাইপ দাড়িয়ে গেছে। শিশুদেরও যে যক্ষ্মা হতে পারে সেটি সামাজিকভাবে অনেকেই মনে করেন না। ফুসফুসের বাইরে যক্ষ্মা বাবা মায়েরা বুঝতে, এমনকি চিকিৎসকেরাও অনেক সময় ধরতে সময় নেন। আর শিশুদের ফুসফুসে যক্ষ্মা হলে, জ্বর, কাশি অন্য অসুখের মত মনে হয়। বাবা মায়েরা হয়ত একটু প্যারাসিটামল দিয়ে দেন এবং প্রায়শই চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করেন, বলছিলেন সায়েরা বানু। ঢাকার আরামবাগ এলাকার ইসমত আরা’র সাথে কথা বলে ঠিক তেমনটাই মনে হল। তার ছেলের বয়স এখন আট বছর। বছর দুয়েক আগে নিয়মিত জ্বর ও কাশিতে খুব দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর যক্ষ্মা শনাক্ত হয়েছে। পেশায় গৃহকর্মী ইসমত আরা বলছেন, “শীতকালে মাঝে মাঝেই জ্বর কাশি থাকতো। ভাবতাম যে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে, ঠাণ্ডা লাগে এই কারণে হয়ত। আমি এলাকার ওষুধের দোকানে নিয়ে যেতাম। কিন্তু দেখতাম যে অসুখ সারে না। একদম শুকায়ে চোখ গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল। তখন শিশু হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা কি যেন বলল পালমো না যেন কি। শিশুদের ক্ষেত্রে ফুসফুসের যক্ষ্মা নির্ণয়েও অনেক সময় দেরি হয়। এর একটি কারণ হতে পারে শিশুরা বলতে পারে না, বোঝে না, কফ বের করতে পারে না। অভিভাবকরাও অনেক সময় খেয়াল করতে দেরি করেন। বড়রা বলতে পারে, কফ ফেলতে পারে, কফের সাথে রক্ত গেলে সেটা বলতে পারে, সেজন্য বড়দের যক্ষ্মা নির্ণয় করা সহজ। বাচ্চারা কফটা গিলে ফেলে তাই সেটা পেটে চলে যায়। এক্ষেত্রে যক্ষ্মা নির্ণয়ে পাকস্থলীর রস বের করে আনা হয়। অনেক ক্ষেত্রে নমুনা নেয়ার জন্য বাচ্চাকে বমি করানো হয়। কফ গিলে ফেলার কারণে জীবাণু বাচ্চাদের পেটে পাওয়া যায়। এছাড়া পরিবারে কারো যক্ষ্মা আছে কি না তার ইতিহাস, এক্স-রে, বাচ্চাদের ত্বকে একটি পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু শিশুদের শরীর থেকে নমুনা নিলেও জীবাণুর উপস্থিতি বড়দের চেয়ে কম থাকে তাই প্রচলিত পরীক্ষাতেও অনেক সময় ধরা পড়ে না।
শিশুরা নিজেরা যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায় কম
শিশুরা বড়দের থেকে খুব দ্রুত আক্রান্ত হয় কিন্তু নিজেরা যক্ষ্মা ছড়ায় খুব কম। শিশুর শরীরে যেহেতু যক্ষ্মার জীবাণুর উপস্থিতি কম থাকে, তাদের যেহেতু ফুসফুসের বাইরের যক্ষ্মা বেশি হয়ে থাকে যা সাধারণত জীবাণু ছড়ায় না, শিশুরা যেহেতু কফ ফেলে না, তাই তারা যক্ষ্মা ছড়ায় না বললেই চলে।
শিশুদের যক্ষ্মার চিকিৎসা ও সেসময় যত্ন
শামীমা আক্তার বলছেন, রোগ নির্ণয় করেই সাধারণত তার চিকিৎসা দেয়ার নিয়ম। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে সেটি করতে গেলে অনেক শিশুই চিকিৎসার আওতার বাইরে চলে যেতে পারে যেহেতু প্রায়শই রোগটি শনাক্তই হয় না। নমুনা পরীক্ষা করতে না পারলে আমরা যেটা করি লক্ষণ মিলে গেলে, সন্দেহ হলে ওষুধের কোর্স শুরু করে দেই। যক্ষ্মার চিকিৎসা সাধারণত ছয় সপ্তাহের। মোট চারটি ওষুধ দেয়া হয়। শিশুদের ঔষধগুলো লিকুইড এবং ওভাবেই বানানো হয় যাতে খেতে ভাল লাগে। যদি ঠিক মতো ওষুধ না খাওয়া হয় তাহলে শিশুটিকে যে ওষুধ দেয়া হয়েছে যক্ষ্মার জীবাণু তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। অর্থাৎ যক্ষ্মার জীবাণু ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা আরো অনেক কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি হয়ে পড়ে। আরামবাগের ইসমত আরা বলছিলেন, সেই কত মাসের যে ওষুধ দিয়েছিল। ঠিক মত খাওয়াতে পারিনি। কয়দিন পর আর ছেলে সে ওষুধ খাবে না। এরপর আবার জ্বর আসা শুরু করলো। অর্থাৎ ওষুধের কোর্স ঠিকমত সম্পন্ন না করায় শিশুটির শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। চিকিৎসার পাশাপাশি যে ঘরে বাতাস প্রবেশ করে এমন ঘরে তাকে রাখা, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার, সুসম খাবার খাওয়ানো, পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা উচিৎ।
সাবধানতা হিসেবে যা করা যেতে পারে
সায়েরা বানু বলছেন, জন্মের সময় বাংলাদেশে বিসিজি নামে একটি টিকা দেয়া হয়। সেটি যক্ষ্মা পুরো ঠেকাতে না পারলেও প্রকট উপসর্গগুলো প্রতিরোধ করে। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন পরিবারে, আশপাশে পাড়ায়, স্কুলে কারো যক্ষ্মা হয়েছে শুনলে শিশুকে তার থেকে দুরে রাখুন। পরিবারে কারোর যক্ষ্মা হলে রোগীকে আইসোলেশনে রাখা উচিৎ। ওই পরিবারে, পাশের বাড়িতে কোন শিশু থাকলে, সে যক্ষ্মা রোগীর সংস্পর্শে এলে, ওই শিশুটির যদি যক্ষ্মা নাও হয়, তবুও হওয়াটা ঠেকাতে তিন অথবা ছয় মাসের ওষুধ দেয়া হয় যাকে বলা হয় ‘টিবি প্রিভেনটিভ থেরাপি’। সেটি খাওয়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন সায়েরা বানু।
শাহনাজ পারভীন, বিবিসি বাংলা