আলোচনায় সুপারিশ
*মানসিক রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন
*স্বাভাবিক রোগীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের মতো মানসিক রোগীদেরও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে
*মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যয় খুব বেশি। দেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ এ ব্যয় বহন করতে পারে না। মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যয় হ্রাস করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন
*দেশে প্রয়োজনের তুলনায় মনোরোগ চিকিৎসকের সংখ্যা নগণ্য। মানসিক রোগের চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি
*মানসিক রোগ সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে
মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ আছে। অস্থিরতা আছে। বিভিন্ন কারণে আমাদের আবেগের পরিবর্তন হয়। বিচার-বিবেচনার পরিবর্তন হয়। একজন মানুষের কথাবার্তা ও আচরণে এর প্রকাশ ঘটে। এসবই হয়তো মানসিক রোগ।
এটি পৃথিবীর অনেক পুরোনো একটি রোগ। মানসিক রোগ নিয়ে সমাজে রয়েছে নানা ভুল ধারণা। সঠিকভাবে চিকিৎসা নিলে মানসিক রোগ থেকে মুক্তিলাভ অথবা এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এসবই আজকের আলোচনার বিষয়। এখন আলোচনা করবেন মো. গোলাম রাব্বানী।
মো. গোলাম রাব্বানী:
বর্তমান সরকার মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এ বছরের প্রতিপাদ্য—মানসিক স্বাস্থ্যের মর্যাদাবোধ, সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য-সহায়তা। মানসিক স্বাস্থ্যের মর্যাদাবোধের কথা এ জন্য আসছে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়। তার অধিকারকে সম্মান দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে মানসিক রোগীকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়।
মানসিক রোগীদের চারটি অবস্থাকে বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৬ প্রণয়ন করেছে। মানসিক রোগীদের কথা বলা বা অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষমতা সীমিত থাকে। তারা তাদের অধিকারের কথা বলতে পারে না। তাদের কোনো প্রয়োজনের কথা বলতে পারে না।
আমাদের সমাজটা এমন যে স্বাভাবিক মানুষও বিভিন্ন কারণে বৈষম্যের শিকার হয়। সেখানে যারা প্রতিবন্ধী, মানসিক রোগী, তারা কতটা অসহায়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ শুধু বাংলাদেশে এমন হচ্ছে, তা নয়। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য হলো, ‘শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা। এ তিনটি বিষয় হলো স্বাস্থ্যের নির্দেশক।’ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে ভালো করছে।
দেশের মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই নিশ্চিত করতে পেরেছে। এখন আমরা বলছি সবার জন্য স্বাস্থ্য। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে মানসিক রোগীদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী:
মানসিক রোগ মানব ইতিহাসের মতো প্রাচীন। স্বাভাবিক রোগীদের চিকিৎসা আর মানসিক রোগীর চিকিৎসার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মানসিক রোগের চিকিৎসা একটু ভিন্ন ধরনের।
এ বছর মানসিক রোগীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ষাটের দশক থেকে স্বাভাবিক মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হতে থাকে এবং এ সময় থেকে স্বাভাবিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি আমাদের অনেকের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়।
এখন থেকে স্বাভাবিক রোগীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের মতো মানসিক রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রেয়াজন। তাহলে মানসিক রোগীকে শুরুতে ভালো করা সম্ভব।
২০০৯ সালে এ রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা পর্যালোচনা করে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যদি মানসিক রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য-সহায়তা দেওয়া যায়, তাহলে মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রতি চারজনের একজন কোনো না কোনো সময় মানসিক সংকটকাল অতিক্রম করে। কিন্তু মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য, কুসংস্কার, ঘৃণা, অবহেলা ব্যাপকভাবে কাজ করে। এ জন্য অন্য রোগের মতো মানসিক রোগ বিবেচনায় গুরুত্ব পায় না। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ছাড়া পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাবে না। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মোহাম্মদ ইবাদুল করিম:
আমরা ওষুধশিল্পের সঙ্গে জড়িত। রোগীদের চিকিৎসা করতে পারি না। তবে তাদের চিকিৎসার জন্য যে প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রয়োজন, সেটা উৎপাদনের চেষ্টা করি। অর্থাৎ আমরা পরোক্ষভাবে অসুস্থ মানুষের পাশে থাকি।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসেছেন। এটা প্রমাণ করে যে মানসিক রোগের বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকেরা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন। আজ ২০১৬ সাল। এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে।
দেশে একসময় এমনও পরিবার ছিল, জীবনে কোনো দিন চিকিৎসকের চেম্বারে যায়নি। তবে এখন আর সে অবস্থা নেই। স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য আজ আমরা আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হচ্ছি। এখন কমিউনিটি হাসপাতালের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে।
স্বাভাবিক রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ খেলে রোগী সেরে ওঠে, ভালো হয়। এটা রোগী যেমন বুঝতে পারে, তেমনি অন্যরাও বুঝতে পারি। মানসিক রোগের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি যে এটা বুঝতেই অনেক সময় লেগে যায়। এটা এখনো সত্যি যে বড় বড় শহরে মানসিক রোগের বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি। গ্রামে এখনো অনেক মানুষ আছে, তারা মানসিক রোগ কী, সেটাই জানে না।
কিছু মানুষ অসংলগ্ন আচরণ করে। তাদের আচরণে মানুষ বিরক্ত হয়। তাকে আমরা পাগল বলি। কিন্তু নিজের পরিবারের সদস্য, স্বামী-স্ত্রীর কেউ একজন বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে মানসিক রোগ আছে। কিন্তু কেউ সেটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু শুরুতে তার পরিচর্যা করলে সে হয়তো আগেই ভালো হয়ে যেতে পারত।
রেজাউল করিম:
আপনারা জানেন যে বর্তমানে শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলেদের থেকে মেয়েরা এগিয়ে আছে। সব মিলিয়ে মেডিকেল শিক্ষা শেষ করতে প্রায় সাত বছর লেগে যায়। এত দীর্ঘ সময় ধৈর্যের সঙ্গে পড়ালেখা করা মেয়েদের পক্ষে সম্ভব। সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ভেবেছে যে শুধু মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়েই একটা মেডিকেল কলেজ চালানো যায়। এখানকার কারিকুলাম অন্যান্য মেডিকেল কলেজের মতো। এখানে নারী-পুরুষ সবাই সমানভাবে চিকিৎসা নিচ্ছে। এখানে মানসিক রোগীরও চিকিৎসা করা হচ্ছে। মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে মেয়েরাই হয়তো প্রাধান্য পায়। মেয়েদের ধৈর্য বেশি। তারা ধৈর্য নিয়ে সেবা করতে পারবেন বলে মানুষ মনে করে।
মানসিক রোগীর কথা যদি বলি, তাহলে বলব যে মাত্র ১ শতাংশ রোগী গুরুতর মানসিক রোগী, যাদের চিহ্নিত করতে পারি। আর অন্যদের আমরা তেমনভাবে চিহ্নিত করতে পারি না। এরা সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করতে পারে। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে মানসিক রোগের নারী চিকিৎসকের সংখ্যা এখনো কম।
বর্তমানে এ সংখ্যা বাড়ছে। মানসিক রোগের চিকিৎসা কিছুটা দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু এখন মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দরিদ্র ও গ্রামের সাধারণ মানুষ এ ব্যয় বহন করতে পারে না। চিকিৎসার ব্যয় হ্রাস করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন। এ এইচ এম মুস্তাফিজুর রহমান: আমাদের সমাজে একেক সময়ে একেক ধরনের মানসিকতা কাজ করে। আমাদের ছোটবেলায় বেত্রাঘাত খায়নি এমন মানুষ খুব কমই আছে। সে সময়ের মানুষ এটাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে এখন সেভাবে গ্রহণ করবে না। এখন শিশু-কিশোরদের মারলে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়া হয়। এটা তার মানসিক আবেগ-অনুভূতিকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে, এখন শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের ওপর বিধিনিষেধ এসেছে। এখনকার বাস্তবতায় এটা খুবই প্রয়োজন। আমাদের সময়ে তেমন কোনো প্রযুক্তিই ছিল না। আমি যখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি, তখন প্রথম টেলিভিশন দেখি। এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক অল্প বয়সে মোবাইল, ইন্টারনেট, স্মার্টফোনসহ অনেক রকম প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তারাও অনেক কিছু জানছে, বুঝছে। ফলে আগের চিন্তাধারায় এখনকার ছেলেমেয়েদের মানুষ করা যাবে না। তবে অভিভাবকদের অনেক ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সন্তানদের অনেক বেশি কার্যকর সময় দিতে হবে। অনেক মা-বাবা দুজনই চাকরি করেন। সন্তানেরা বাসায় একা থাকে। এটা তাদের মনের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে। প্রায়ই দেখি স্কুলের সময় স্কুলের পোশাক পরে অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন লেকের কাছে, পার্কে গল্প করছে। এভাবে চলতে থাকলে সন্তানেরা একসময় ভুল পথে চলে যাবে। তাই সন্তানেরা কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মেশে—সব বিষয়ে খবর রাখতে হবে। তাদের যেকোনো সমস্যায় ভালোবাসা নিয়ে পাশে থাকতে হবে। অভিভাবকেরা এসব বিষয়ে সতর্ক না থাকলে সন্তানেরা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
আহসানুল হাবীব:
পাবনা মানসিক হাসপাতালে ৫০০ শয্যা আছে। কিন্তু চিকিৎসক আছেন সর্বোচ্চ ১৬ জন। শয্যাসংখ্যার তুলনায় এটা খুবই নগণ্য। হাসপাতালে ২২ বছরের পুরোনো রোগী আছে। তাদের কোনোভাবে বাড়িতে পাঠানো যায় না। পাঠালে বাড়ি থেকে অত্যাচার করে আবার ফেরত পাঠানো হয়। আস্তে আস্তে পৃথিবীতে মানসিক রোগীর চিকিৎসার ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এখন বলা হচ্ছে, হাসপাতালে কম সময় থাকতে হবে। কমিউনিটিতে বা সমাজে বেশি সময় থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে পাবনা হাসপাতালে রোগী ভর্তি হলে তাকে আর কেউ ফেরত নেন না। ১৯৯০ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে যুক্ত হই। তখন মানসিক রোগের জন্য দুই থেকে তিনটি ওষুধ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বইয়ে যেসব ওষুধ লেখা আছে, তার প্রায় সব ওষুধ বাংলাদেশে পাওয়া যায়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগে আউটডোরে প্রতিদিন দুই বা তিনজন রোগী আসত। এখন প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন রোগী আসে। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সাইকিয়াট্রিস্ট ছিলেন ২৪ হাজার। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ৪৯ হাজার। ১৯৯০ সালে আমাদের দেশে সাইকিয়াট্রিস্ট ছিলেন বড়জোর ৫০ জন। এখন ২২০ জন। যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। পাশের দেশ ভারতে সংখ্যা সম্ভবত তিন লাখের জন্য একজন। আমাদের দেশে ৭ লাখ ৫০ হাজারের জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। আমাদের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নেই বললেই চলে। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে না ভাবলে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না।
সুলতানা আলগিন:
বয়সভেদে মানসিক চাপের ভিন্নতা দেখা যায়। ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে যারা কিশোর-কিশোরী তাদের সমস্যা হলো পড়াশোনায় চাপ, মা-বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সুলতানা আলগিন ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ইত্যাদি। এসব কারণে এরা অনেক চাপ অনুভব করে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়, পেশাগত জীবনে অপূর্ণতা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চাপ ইত্যাদি। ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জটিলতা হয় প্রেমবিষয়ক ঘটনায়। এ জন্য তারা বিষণ্নতায় ভোগে। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে কেউ অবসরে গেলে বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়। বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে অমিল, স্বামীর বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় ও প্রসবোত্তর সময়ে বিভিন্ন ধরনের দুশ্চিন্তা তাঁদের মানসিক রোগের কারণ। মায়েদের গর্ভাবস্থায় মানসিক চাপ থাকলে তাঁর সন্তানের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। আর চাপ বাড়তে বাড়তে একসময় মানসিক রোগীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। যেকোনো মানুষের মানসিক চাপমুক্ত থাকাটা জরুরি।
আবদুল্লাহ আল মামুন:
২০০১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘দূরে ঠেলে নয় কাছে রেখেই মানসিক রোগীদের যত্ন নিন’। এরই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা বলতে পারছি, কীভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করব।
দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের ১২ শতাংশ উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা ও বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। তাঁদের অসুস্থতার জন্য দৈনিক কর্মঘণ্টা নষ্টের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে রোগী ও তাঁর স্বজনদের বিভিন্ন প্রকার ভোগান্তি ও মানসিক অশান্তি। ২০০০ সালে আউটডোরে রোগী এসেছে ৮ হাজার। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা হয়েছে ১৫ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্য কার্যপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আমরা মানসিক স্বাস্থ্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। কিন্তু সেটা কীভাবে, এটি একটি বড় প্রশ্ন। চিকিৎসকের সংখ্যা যদি বর্তমানের চার গুণও বাড়ানো হয়, তাহলেও ১ কোটি ৬০ লাখ সাইকোসিস রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না। অন্যান্য সমস্যা বাদই দিলাম। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এ কারণে মেডিকেল কলেজগুলোতে মানসিক বিভাগ সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। দেশে ৩০টি সরকারি ও ৫৫টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে। এগুলো রেফারেল সেন্টার হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। যেখানে মেডিকেল কলেজ নেই, সেখানে বিকল্প পদ্ধতিতে সেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
এম এস আই মল্লিক:
মানুষের স্বাস্থ্য একটি সামগ্রিক বিষয়। শারীরিক ও মানসিক—সবভাবে সুস্থ থাকলেই একজন মানুষকে সুস্থ বলা যাবে। কোনো অসুস্থ জাতি উন্নতি করেছে, এমন কোনো নজির পৃথিবীতে নেই। দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছে। মানসিক রোগের ক্ষেত্রে জনবল বাড়াতে না পারলে যত আলোচনাই করি না কেন, সেটা কাজে আসবে না। মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি—সব পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একজন মানুষের শারীরিক রোগের জন্য মানসিক রোগ হয়। আবার মানসিক রোগের জন্যও শারীরিক রোগ হয়। ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, অ্যাজমা, আথ্র৴াইটিস প্রভৃতি রোগের রোগীরা অধিকাংশই মানসিক রোগে ভোগেন। ক্যানসারের রোগীদের ১০০ শতাংশই মানসিক রোগে ভোগেন। এ জন্য শুধু হাসপাতালে মানসিক রোগ অন্তর্ভুক্ত করলে হবে না, প্রতি বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য যে জনবল প্রয়োজন, আমাদের দেশের বাস্তবতায় সেটি তৈরি সম্ভব নয়। এ জন্য দেশের উপযোগী করে পরিবর্তিত নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এখানে আরও বিকল্প হলো যাঁরা মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁরা কয়েকটি ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেবা দেবেন। মানসিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেবেন এবং বিভিন্ন হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। চিকিৎসা পেশায় যাঁরা আছেন তাঁরা সবাই যেন মানসিক রোগীকে সেবা দিতে পারেন—এভাবে বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে কাজ না করলে সব মানসিক রোগীকে সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
মামুন হুসাইন:
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ঠিক কী করেন, বেশির ভাগ মানুষের এ সম্পর্কে ধারণা এখনো যথেষ্ট সুস্পষ্ট নয়। মনোরোগে আক্রান্ত রোগী মাত্রই বিপজ্জনক কিংবা মনোরোগকে উন্মাদনার পরিপূরক ভাবার সরল ব্যাখ্যাটি কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অ্যারিস্টটল সম্ভবত বলতেন, সামান্য উন্মাদনা নেই, এ রকম মানুষ কখনো ভালো হৃদয়ের হতে পারে না। উত্তম মনঃস্বাস্থ্যের অনেক বৈশিষ্ট্য থাকে, যেমন সঠিক মনঃস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষ হবেন আত্মমর্যাদাশীল, আস্থাবান, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা জ্ঞাপনের যোগ্যতাসম্পন্ন। তিনি দীর্ঘমেয়াদি আবেগপ্রবণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হন, তাঁর আত্মোপলব্ধি থাকে, তিনি অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন, তিনি অপরকে ক্ষমা করতে পারেন, নিজেকে চারপাশের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারেন, তিনি হন সৃজনশীল ইত্যাদি। অনেকে মনঃস্বাস্থ্যকে বিবেচনা করেন ‘সামাজিক পুঁজি’ হিসেবে। স্বাস্থ্য-অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা অঙ্ক কষে দেখেছেন, মনোরোগ কর্মক্ষমতা বিনষ্ট করে অর্থনৈতিক ক্ষতি করে, দারিদ্র্য বাড়ায়, কর্মহীন করে; এমনকি শারীরিক ব্যাধিকেও ত্বরান্বিত করে। ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট’-এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য দারিদ্র্য, নারীবৈষম্য, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু রোধ করা। সঠিক মনঃস্বাস্থ্যের পরিচর্যা এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। অনেক প্রসূতি মনোরোগে আক্রান্ত হন। তাঁর সঠিক চিকিৎসা সম্ভব। নারীর প্রতি সহিংসতাজনিত মনোবিকারের চিকিৎসা সম্ভব। দুর্যোগের পর জনগণের হতাশা ও মানসিক চাপ দূর করা সম্ভব। শিশু-কিশোর ও যুবকদের মনঃস্বাস্থ্য গঠনে সহায়তা দেওয়া সম্ভব, যখন দুই-তৃতীয়াংশ মনোরোগ শুরু হয় ১৫-২৫ বছরের মধ্যে। খুব মোটা দাগে মনঃস্বাস্থ্যের সঠিক পরিচর্যা আমাদের উন্নয়নকে গতিশীল করে।
জ্যোতির্ময় রায়:
মানসিকভাবে যে সুস্থ, সে নিজের জন্য কাজ করবে। অন্যের জন্য কাজ করবে। সমাজের জন্য কাজ করবে। আজ জঙ্গিবাদের উত্থান দেখছি। যারা জঙ্গি, নিশ্চয়ই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অভাব রয়েছে। মানসিকভাবে সুস্থ অথচ সে জঙ্গি, এটা কোনোভাবেই ভাবা যায় না। এখন নতুন যেসব চিকিৎসক পাস করে বের হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সাইকিয়াট্রি জ্ঞান কতটুকু আছে, সেটা ভাবতে হবে। আমি যেখানে কাজ করি, সেখানে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমি মনে করি, চিকিৎসকদের সিলেবাসে জোরালোভাবে সাইকিয়াট্রি বিষয়টি আনা প্রয়োজন। ডাক্তারি পরীক্ষায় এ বিষয় থেকে প্রশ্ন থাকা প্রয়োজন। তা না হলে শিক্ষার্থীরা এটা পড়বে না। এখন বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে। ডাক্তারি পাস করছেন, কাজে যোগ দিচ্ছেন কিন্তু তাঁরা সব সাইকিয়াট্রি না জানা চিকিৎসক। এ জন্য তাঁদের কাছে যখন রোগী আসবে, তখন হয় তাঁরা ভয় পাবেন অথবা রোগীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন। সাইকিয়াট্রি অ্যাসোসিয়েশনকে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্য অনুরোধ করছি।
ধীরাজ মোহন বিশ্বাস:
ধনী-দরিদ্র সবাই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। মা-বাবা দুজনের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া থাকলে তাঁদের সন্তানদের মানসিক রোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। কোনো পরিবারে যখন মানসিক রোগী থাকেন, তখন তারা বিভিন্নভাবে সামাজিক কুসংস্কারের শিকার হয়ে অপচিকিৎসা নেন। এভাবে অপচিকিৎসা করতে করতে সব অর্থ ব্যয় করে দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হতে পারে। কিশোরদের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালে কিছু খারাপ আচরণ দেখা যেতে পারে। সঠিকভাবে এগুলো সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। অনেক কিছু আলোচনায় এসেছে। মনে হয় উদ্যোগ নিলেই সবকিছু ঠিক হবে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ বাজেট প্রয়োজন, তার সামান্য পরিমাণও এখানে নেই। সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সত্যিকার অর্থে কোনো বাজেট নেই। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে কিছু রোগী দেখার সুযোগ আছে, কিন্তু ইনডোরে সে সুযোগ নেই। শুধু খুলনা কেন, পদ্মার ওপারে কোনো হাসপাতালেই মানসিক রোগীদের ভর্তি হয়ে চিকিৎসার সুযোগ নেই। এসব অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
শফিউল হাসান:
আমাদের সবচেয়ে আগে প্রয়োজন চিকিৎসক সমাজের সচেতনতা। দেশের অনেক হাসপাতালে কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট নেই। এ ক্ষেত্রে সাইকিয়াট্রি বিভাগ থাকার প্রশ্নই আসে না। সরকারি মেডিকেল কলেজে অনেক ক্ষেত্রে সাইকিয়াট্রিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সাইকিয়াট্রি বিভাগ একেবারেই নেই। অথচ শিক্ষার্থীরা সাইকিয়াট্রি না জেনে ডাক্তারি পাস করছেন। উন্নত বিশ্বে সাইকিয়াট্রি জানা ছাড়া কেউ চিকিৎসক হতে পারেন না। উন্নত বিশ্বে রোগীদের ইতিহাস জেনে চিকিৎসা করা হয়। আমাদের দেশে কেউ যদি বুকের ব্যথায় কোনো চিকিৎসকের কাছে যান, তিনি অনেক পরীক্ষা দেন। এ জন্য গরিব রোগীরা তঁাদের চিকিৎসার সামর্থ্য হারান। অথচ অনেক ধরনের মানসিক কারণেও বুকের ব্যথা হতে পারে। রোগীর ইতিহাস জানলে অনেক রোগের চিকিৎসা সহজ হয়। সাধারণ মানুষকে মনোবিজ্ঞান বোঝানোর আগে সম্মানিত চিকিৎসকদের সচেতন করতে হবে। মনোবিজ্ঞান জানেন না, এমন একজন চিকিৎসকের কাছে যখন একজন মানসিক রোগী যান, তখন চিকিৎসক মানসিক রোগের চিকিৎসা না করে সব ধরনের পরীক্ষা করাতে থাকেন। কেবল পরীক্ষা দিয়ে রোগ নির্ণয় করা যায় না। এভাবে একজন মানসিক রোগীর চিকিৎসা হয় না। সবার আগে প্রয়োজন মানসিক রোগের চিকিৎসক সমাজ তৈরি করা।
আব্দুল কাইয়ুম:
মানসিক রোগীর তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই অপর্যাপ্ত। আমাদের জরুরি প্রয়োজন হলো মানসিক রোগের চিকিৎসক সমাজ তৈরি করা এবং একই সঙ্গে আরও বেশি মানসিক হাসপাতাল তৈরি করা।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাববেন বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
যাঁরা অংশ নিলেন-
মো. গোলাম রাব্বানী : সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট
মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট
এম এ হামিদ : পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
এ এইচ এম মুস্তাফিজুর রহমান: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট
আহসানুল হাবীব : সাবেক পরিচালক, মানসিক হাসপাতাল, পাবনা
এম এস আই মল্লিক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
আবদুল্লাহ আল মামুন : বিভাগীয় প্রধান, সাইকিয়াট্রি বিভাগ,
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
মামুন হুসাইন : বিভাগীয় প্রধান, সাইকিয়াট্রি বিভাগ,
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
জ্যোতির্ময় রায় : বিভাগীয় প্রধান, সাইকিয়াট্রি বিভাগ,
রংপুর মেডিকেল কলেজ
ধীরাজ মোহন বিশ্বাস : সাবেক অধ্যক্ষ, খুলনা মেডিকেল কলেজ
সুলতানা আলগিন : সহযোগী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
রেজাউল করিম : অধ্যক্ষ, উইমেন্স মেডিকেল কলেজ, সিলেট
শফিউল হাসান : সহযোগী অধ্যাপক (অব.), সাইকিয়াট্রি বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
মোহাম্মদ ইবাদুল করিম : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস লি.
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো।