সাবেরা খাতুন- মানবদেহের যকৃতে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের (HCV) আক্রমণের ফলে হেপাটাইটিস সি রোগ হয়েছে বলা হয়ে থাকে। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই এই অসুস্থতা দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে, যাকে ক্রনিক বা দুরারোগ্য হেপাটাইটিস সি সংক্রমণ বলে। জেনে রাখুন ভয়ংকর এই রোগটির ব্যাপারে।
হেপাটাইটিস সি একটি সংক্রামক রোগ। মানবদেহের যকৃতে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের (HCV) আক্রমণের ফলে হেপাটাইটিস সি রোগ হয়েছে বলা হয়ে থাকে। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই এই অসুস্থতা দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে, যাকে ক্রনিক বা দুরারোগ্য হেপাটাইটিস সি সংক্রমণ বলে।
লক্ষণ সমূহ :
বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই প্রাথমিক কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়না বলে ক্রনিক হেপাটাইটিস সি শনাক্ত করা কঠিন। কেবলমাত্র ২৫ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ যেমন- ক্লান্তি, পেশীর ব্যথা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। ক্রনিক হেপাটাইটিস সি এর ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ওজনহ্রাস এবং রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা হয়। ক্রনিক হেপাটাইটিস সি এর ক্ষেত্রে লিভারে ক্ষত সৃষ্টি হয় যাকে লিভার সিরোসিস বলে এবং এতে লিভার অকার্যকর হয়ে পরে। তখন যে উপসর্গগুলো দেখা যায় তা হল- জন্ডিস, গাড় হলুদ প্রস্রাব ও খুব সহজেই রক্তপাত বা আঘাতে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া। লিভার ক্ষতিগ্রস্থ না হওয়া পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে পারেন না যে তার হেপাটাইটিস সি হয়েছে। দশ বছর পর্যন্ত এটি সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হেপাটাইটিস সি শনাক্ত করা যায়। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট যদি পজিটিভ আসে তাহলে বায়োপসি এবং ইমেজিং টেস্ট করতে হয়।
কাদের হয়?:
হেপাটাইটিস সি তে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের সংস্পর্শে এটি ছড়িয়ে পরে। এটি হতে পারে-
· হেপাটাইটিস সি তে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সূঁচ ও সিরিঞ্জ অন্য কেউ ব্যবহার করলে।
· হেপাটাইটিস সি তে আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে গর্ভজাত সন্তানে এটি সংক্রমিত হতে পারে।
· শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের হতে পারে।
· এইডস থাকলে
· অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ও অকার্যকর সরঞ্জাম দিয়ে দেহের কোন অংশে ছিদ্র বা উল্কি করা
· দীর্ঘদিন যাবত কিডনি ডায়ালায়সিস করলে
· কারাগারে থাকলে
· ১৯৯২ সালের পূর্বে রক্তদান বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে থাকলে।
· ১৯৪৫-১৯৬৫ সালের মধ্যে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তারা হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের সর্বোচ্চ প্রকোপের মধ্যে আছেন।
চিকিৎসা :
হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসায় অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ দেয়া হয় শরীর থেকে ভাইরাস দূর করার জন্য। ঔষধের কোর্স সম্পন্ন করার ১২ সপ্তাহ পরও যেন শরীরে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস খুঁজে পাওয়া না যায় এটাই চিকিৎসার লক্ষ। গত দশ বছরে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের ঔষধ সহজলভ্য হয়েছে এবং সময়ের সাথে সাথে উন্নত হচ্ছে। সাধারণত ইন্টারফেরন ও রিবাভিরিন এর সমন্বয়ে হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসা করা হয়। যা দ্বৈত থেরাপি নামে পরিচিত। ইন্টারফেরন সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং রিবাভিরিন ভাইরাসকে ধ্বংস করে। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের জন্য প্রায় এক বছর ঔষধ সেবন করতে হয়।
ঔষধ গ্রহণের সময়ে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, তাহল-
· বমি বমি ভাব এবং বমি করা
· জ্বর ও শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
· পেশীর ব্যথা
· চুল পড়ে যাওয়া
· কেউ কেউ গুরুতর বিষণ্ণতায় ভোগেন
· উচ্চ রক্তচাপ ওথাইরয়েডের সমস্যাও হতে পারে
চিকিৎসা গ্রহণের সময় চিকিৎসকের নিয়মিত রোগীকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস সি এর ক্ষেত্রে লিভার এতোটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় যে প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়তে পারে। লিভার প্রতিস্থাপন করলেই যে রোগমুক্ত হওয়া যাবে এমন কোন কথা নেই। লিভার ট্রান্সপ্লান্টের পরেও ভাইরাসনাশক ঔষধ সেবন করতে হবে যাতে নতুন লিভারে সংক্রমণ না হতে পারে।
এখন পর্যন্ত হেপাটাইটিস সি এর টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। আপনার চিকিৎসক আপনাকে হেপাটাইটিস এ ও হেপাটাইটিস বি এর টিকা নেয়ার পরামর্শ দেবেন কারণ এই পৃথক দুটি ভাইরাসের কারণেও যকৃত ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং হেপাটাইটিস সি এর চিকিৎসায় জটিলতার সৃষ্টি করে।
জীবনযাপন ও প্রতিকার :
যদি পরীক্ষার মাধ্যমে হেপাটাইটিস সি শনাক্ত করা যায় তাহলে আপনার চিকিৎসক ঔষধের পাশাপাশি আপনার জীবনযাপনের কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ দেবেন যা আপনাকে দীর্ঘদিন যাবত সুস্থ ও সুরক্ষিত থাকতে সাহায্য করবে যেমন-
· অ্যালকোহল সেবনের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করতে হবে।
· যকৃতের ক্ষতি করতে পারে এমন ঔষধ সেবন বাদ দিতে হবে।
· আপনার রক্তের সংস্পর্শে যেন কেউ না আসে সেই বিষয়টি খেয়াল কতে হবে। এজন্য আপনার শরীরে কোন আঘাত পেয়ে রক্ত ঝরলে সেটা যেন অন্য কেউ স্পর্শ না করে, রেজর ও টুথব্রাশ আলাদা রাখুন, রক্ত, সিম্যান বা বীর্য ও অঙ্গদান থেকে বিরত থাকুন। আপনার পরিচিত ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিষয়টি অবগত করুন।