পেটে সমস্যা? (Stomach Problems)
ডাক্তারঃ মোঃ শরিফুল ইসলাম
আমাশয়, ডায়রিয়া, পেটের ব্যথা কিংবা হজমের অসুবিধা—পেটের পীড়া বলতে আমরা সাধারণত এসবই বুঝি। কমবেশি আমরা সবাই এ সমস্যায় পড়ি। পেটের পীড়াকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। খাদ্যনালি (পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয়, ক্ষুদ্রান্ত্র কিংবা বৃহদন্ত্রের রোগ) এবং দ্বিতীয়ত লিভারের প্রদাহ।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, স্বল্পমেয়াদি পেটের পীড়া আমাশয়, রক্ত আমাশয়, ডায়রিয়া এ সময়টাতে বেশি হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি পেটের পীড়ার সমস্যাগুলো সারা বছর হয়ে থাকে। যেমন গ্যাস্ট্রিক আলসার, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম, খাদ্য হজম না হওয়া, বৃহদন্ত্রের প্রদাহজনিত পেটের পীড়া ইত্যাদি। একটু সচেতন হলেই এসব সমস্যায় ভালো থাকা যায়।
আমাশয়
অ্যামিবিক ডিসেন্ট্রি স্বল্পমেয়াদি পেটের পীড়ার অন্যতম কারণ; যা অ্যান্টাবিমা হিস্টোলাইটিকা নামক জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত। এটি মূলত পানিবাহিত রোগ। যেখানে-সেখানে খোলা বা বাসি খাবার খেলে অথবা দূষিত পানি পান করলে এ রোগ হয়। শহর অঞ্চলে রাস্তার পাশের খোলা খাবার খেলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে যাঁরা যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করেন, নদী ও পুকুরের পানি পান করেন, তাঁরা এ রোগে আক্রান্ত হন বেশি।
এ রোগের উপসর্গ হঠাৎ করে দেখা দেয়। যেমন ঘন ঘন পেটে মোচড় দিয়ে পায়খানা হওয়া, পায়খানার সঙ্গে রক্ত বা আমমিশ্রিত অবস্থায় যাওয়া, পায়খানায় বসলে উঠতে ইচ্ছা হয় না বা ওঠা যায় না। ২০-৩০ বার পর্যন্ত পায়খানাও হতে পারে।
রক্ত আমাশয়
রক্ত আমাশয়ের প্রধান কারণ হলো একধরনের ব্যাকটেরিয়া; যা দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। রক্ত আমাশয়ের লক্ষণ হলো পেটে তীব্র মোচড় দিয়ে ব্যথা হওয়া, অল্প অল্প করে বারবার পায়খানা হওয়া, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া এবং মলদ্বারে তীব্র ব্যথা হওয়া।
ডায়রিয়া
* ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ খাদ্যে নানা ধরনের পানিবাহিত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ।
* শিশুদের ডায়রিয়া সাধারণ রোটা নামক ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে।
* নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে যে ডায়রিয়া মহামারি আকারে দেখা দেয়, তার অন্যতম কারণ হলো কলেরা।
* পাতলা পায়খানা হলে যদি তা চাল ধোয়া পানির মতো হয়, তবে সেটা কলেরার লক্ষণ। এর সঙ্গে তলপেটে ব্যথা হওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, ঘন ঘন পায়খানায় যাওয়া এবং শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া এ রোগের উপসর্গ। এ সময়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পেটের পীড়ার অন্য কারণগুলো হচ্ছে পিত্তথলি, পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয় এবং অন্ত্রের প্রদাহ।
পেটের পীড়া প্রতিরোধে করণীয়
* বাইরের খোলা খাবার বা বাসি কোনো খাবার খাওয়া যাবে না।
* পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
* খাদ্য গ্রহণের আগে এবং মলত্যাগের পরে নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। যেসব অভিভাবক শিশুকে খাওয়ান, তাঁরা শিশুকে খাবার দেওয়ার আগে এবং শিশুর মলত্যাগের পর একই নিয়মে হাত পরিষ্কার করবেন।
* পরিষ্কার পানিতে আহারের বাসনপত্র, গৃহস্থালি ও রান্নার জিনিস এবং কাপড়চোপড় ধোয়া সম্পন্ন করতে হবে এবং প্রয়োজনে সাবান ব্যবহার করতে হবে।
* পায়খানার জন্য সব সময় স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করতে হবে। রান্নাঘর ও বাথরুমের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে হবে।
* যাঁরা গ্রামে বসবাস করেন, তাঁদের যেখানে-সেখানে বা পুকুর-নদীর ধারে মলত্যাগের অভ্যাস পরিহার করতে হবে।
* খালি পায়ে বাথরুমে বা মলত্যাগ করতে না গিয়ে স্যান্ডেল বা জুতা ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
* ফোটানো পানি ব্যবহার করতে হবে এবং ফোটানোর ব্যবস্থা না থাকলে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে।
* তৈরি করা খাদ্যসামগ্রী এবং পান করার নির্ধারিত পানি ঢেকে রাখতে হবে।
পেটের পীড়ার চিকিৎসা
* স্বল্পমেয়াদি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত রোগীর শরীর খুব তাড়াতাড়ি পানিশূন্য হয়ে যায়। এই অবস্থা প্রতিরোধের জন্য রোগীকে প্রচুর পরিমাণে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। প্রতিবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর খাওয়ার স্যালাইন খেতে হবে।
* শরীরে জ্বর থাকলে এবং পেটে ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যবস্থা নিতে হবে।
* যেহেতু ভাইরাসজনিত কারণে পেটের পীড়া বেশি হয়; তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোগীকে কোনো ধরনের ওষুধ না খাওয়ানোই শ্রেয়। তবে শিশুর শরীর যাতে পানিশূন্য না হয়, সে জন্য প্রতিবার পাতলা পায়খানা হলে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি শিশুকে সব ধরনের খাদ্য খাওয়ানো অব্যাহত রাখতে হবে। যদি শিশু মায়ের দুধ পান করে থাকে, তবে কোনো অবস্থাতেই তা বন্ধ করা যাবে না।
মনে রাখবেন, পেটের পীড়া প্রতিরোধে সচেতনতাই সবচেয়ে বড় পন্থা। অনেকে কবিরাজি, গাছগাছড়া বা ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে এজাতীয় পেটের পীড়া থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে রোগীর ভোগান্তিই কেবল বাড়ে এবং রোগও জটিল রূপ ধারণ করে।